কুষ্টিয়া জেলা ম্যাপ, কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস

কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস

বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের ঐতিহ্যবাহী কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস বেশ সুদূরপ্রসারী। অতি প্রাচীনকাল থেকে কুষ্টিয়া জেলার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি একটি মানচিত্র তৈরি করেন যাতে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় বেশ কয়েকটি দ্বীপ দেখা যায়। ধারণা করা হয়, এই ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চলই কুষ্টিয়া।

সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এখানে একটি নদীবন্দর স্থাপিত হয়। যদিও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ বন্দর বেশি ব্যবহার করত, তবুও নীলচাষী ও নীলকরদের আগমনের পরেই নগরায়ন শুরু হয়। ১৮৬০ সালে কলকাতার সাথে সরাসরি রেললাইন স্থাপিত হয়। একারণে এ অঞ্চল শিল্প-কারখানার জন্য আদর্শ স্থান বলে তখন বিবেচিত হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস(১৮৯৬), রেণউইক যজ্ঞেশ্বর এণ্ড কোং (১৯০৪) এবং মোহিনী মিলস (১৯১৯) প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এই তিনটি মহাকুমা নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর আলাদা জেলা হিসেবে পৃথক হয়ে গেলে কুষ্টিয়ার ৬টি থানা নিয়ে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা গঠিত হয়।

Table of Contents

কুষ্টিয়া জেলার নামকরণ

কুষ্টিয়া জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মন্তব্যটি হ্যামিল্টনের গেজেটিয়ার সূত্রে পাওয়া যায়। এখানে বলা আছে, এখানে প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপাদিত হতো। পাটকে স্থানীয় জনগোষ্ঠী কুষ্টি নামে ডাকতো, আর এ থেকেই কুষ্টিয়া নামটি এসেছে। আবার অনেকেই বলেন, সম্রাট শাহজাহানের সময়কালের কুষ্টি বন্দর কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের উৎপত্তি হয়েছে। ভিন্ন আরেকটি মতে, ফরাসি শব্দ কুশতহ থেকে কুষ্টিয়া নামকরণ করা হয়েছে, যার অর্থ ছাই দ্বীপ।

অবস্থান

কুষ্টিয়া জেলার উত্তরে রাজশাহী নাটোর ও পাবনা, দক্ষিণ চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলা, পূর্বে রাজবাড়ী এবং পশ্চিমে মেহেরপুর জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অবস্থিত। ভারতের সঙ্গে কুষ্টিয়ার ৪৬.৬৯ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। কুষ্টিয়া জেলার আয়তন এক হাজার ছয় শত একুশ বর্গ কিলোমিটার। পদ্মা, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, কালিগঙ্গা, কুমারখালী নদীগুলো কুষ্টিয়ার মধ্যে দিয়েই বয়ে গেছে।

জনসংখ্যা

২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী কুষ্টিয়া জেলার জনসংখ্যা প্রায় ২৩,৬৬,৮১১ জন যার মধ্যে ৫০.৮৬% পুরুষ ও ৪৯.১৪% মহিলা। ৯৫.৭২% মুসলিম, ৪.২২% হিন্দু ও ০.০৬% অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর বাস।

কুষ্টিয়া জেলার উপজেলা সমূহ

কুষ্টিয়া জেলায় মোট ৬ টি উপজেলা

  • কুষ্টিয়া সদর উপজেলা
  • কুমারখালী উপজেলা
  • খোকশা উপজেলা
  • ভেড়ামারা উপজেলা
  • দৌলতপুর উপজেলা
  • মিরপুর উপজেলা

কুষ্টিয়া জেলার পৌরসভা সমূহ

কুষ্টিয়া জেলায় মোট ৫ টি পৌরসভা। ৬ টি উপজেলার মধ্যে দৌলতপুর উপজেলায় পৌরসভা নাই। অবশিষ্ট ৫ টি উপজেলা শহরকে কেন্দ্র করে পৌরসভাগুলো গঠিত। যার মধ্যে কুমারখালী বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা ও কুষ্টিয়া পৌরসভা বাংলাদেশর ২য় বৃহত্তম পৌরসভা।

  • কুষ্টিয়া পৌরসভা (আয়তন ৪২.৭৯ বর্গ কিলোমিটার, ওয়ার্ড সংখ্যা ২১ টি)
  • কুমারখালী পৌরসভা (আয়তন ১১ বর্গ কিলোমিটার, ওয়ার্ড সংখ্যা ৯ টি)
  • খোকশা পৌরসভা (আয়তন ১২.৩৮ বর্গ কিলোমিটার, ওয়ার্ড সংখ্যা ৯ টি)
  • ভেড়ামারা পৌরসভা (আয়তন ১২ বর্গ কিলোমিটার, ওয়ার্ড সংখ্যা ৯ টি
  • মিরপুর পৌরসভা (আয়তন ৯.২২ বর্গ কিলোমিটার, ওয়ার্ড সংখ্যা ৯ টি)

অর্থনীতি

ধন, পাট, আখ, ভুট্রা, পেয়াজ, তামাক, পান ইত্যাদি এই জেলার প্রধান উৎপাদিত কৃষিপণ্য। যদিও বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মত কুষ্টিয়ার অর্থনীতি কেবল মাত্র কৃষি নির্ভর নয়। চাষাবাদের পাশাপাশি কুষ্টিয়াতে অনেক শিল্প গড়ে উঠেছে। তামাক শিল্প, চাল শিল্প ও ফেব্রিকস শিল্পে কুষ্টিয়া বেশ অগ্রসর।

কুষ্টিয়াতে ১২০ টি বৃহৎ শিল্প, ২৩০ টি মাঝারী শিল্প, ৬,২১২ টি ক্ষুদ্র শিল্প ও ২১,৮৩৭ টি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে অন্যতম দেশের সর্ববৃহৎ কেবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিআরবি কেবলস, দেশের সর্ববৃহৎ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভেড়ামারা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কিয়াম মেটাল এন্ডাস্ট্রিজ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, কেএনবি ফিড, বুলবুল টেক্সটাইলস, রানা টেক্সটাইলস, নাসির টোব্যাকো, দি ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো ইত্যাদি।

কুষ্টিয়ার খাজানগরে প্রায় চারশত রাইচ মিল গড়ে উঠেছে যেখান হতে বাংলাদেশের প্রায় ৭০% চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ জেলার অনেক পণ্য বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে।

কুষ্টিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

শিক্ষা-দিখ্যায় এই জেলা বেশ অগ্রগামী। আঠার শতকের মাঝামাঝি হতে এই জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্থিত্ব পরিলক্ষিত হয়। কুমারখালী এম এন পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় (স্থাপিতঃ ১৮৫৬ খ্রিঃ), কুমারখালী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় (স্থাপিতঃ ১৮৬৩ খ্রিঃ), কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (স্থাপিতঃ ১৮৭৬ খ্রিঃ) হরিনারায়ণপুর হাইস্কুল (স্থাপিতঃ ১৮৯১ খ্রিঃ), মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয় (স্থাপিতঃ ১৮৯৮ খ্রিঃ), আমলা সদরপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় (স্থাপিতঃ ১৮৯৯ খ্রিঃ) অন্যতম।

এছাড়াও অনেকগুলো শতবর্ষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই জেলায় কয়েছে যার মধ্যে মহিষকুন্ডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সিরাজুল হক মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, কুষ্টিয়া হাই স্কুল, কুওয়াতুল ইসলাম কামিল মাদ্রাসা, কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ অন্যতম। স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও এই জেলায় অবস্থিত।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা

  • সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১ টি (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
  • বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১ টি (রবিন্দ্র মৈত্রি বিশ্ববিদ্যালয়)
  • সরকারি মেডিকেল কলেজ ১ টি (কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল)
  • বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ১ টি (সেলিমা বেগম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, নির্মানাধীন)
  • সরকারি কলেজ ০৯ টি
  • বেসরকারি কলেজ ৩০ টি
  • জেলা স্কুল ১ টি
  • নাসিং কলেজ (সরকারি ১ টি, বেসরকারি ০৬ টি)
  • মেডিকেল এ্যসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুল (সরকারি ১ টি, বেসরকারি ৫ টি)
  • সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ১ টি
  • বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ১০ টি
  • উচ্চ বিদ্যালয় (সরকারি ৩ টি, বেসরকারি ১৭৩ টি)
  • সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪০০ টি
  • মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২২৯ টি
  • ডিগ্রি কলেজ ২৪ টি
  • মাদ্রাসা ৭৫ টি

কুষ্টিয়া জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়া জেলা শিল্প ও সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন এবং বাউল সম্রাট লালনের তীর্থভূমি, গীতিকার, সুরকার ও কবি আজিজুর রহমান, এ জনপদে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট কবি দাদ আলী, লেখিকা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রথিকৃত কাঙাল হরিণাথ মজুমদার, নীল বিদ্রোহের নেত্রী প্যারী সুন্দরী, স্বদেশী আন্দোলনের নেতা বাঘা যতিন, প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী, সঙ্গীত শিল্পী মোঃ আব্দুল জববার, ফরিদা পারভীন সহ অসংখ্য গুণীজনের পীঠস্থান কুষ্টিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে।

এছাড়াও এই জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন

  • ওহাবি আন্দোলনের নেতা কাজী মিয়াজান
  • প্রখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র
  • গীতিকার ও লোকসঙ্গীত শিল্পী গগন হরকরা
  • প্রাবন্ধিক রায় বাহাদুর জলধর সেন
  • ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
  • বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল
  • শিশু সংগঠক রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই)
  • নাট্যকার কল্যাণ মিত্র
  • অভিনেতা রাজু আহম্মেদ
  • চলচিত্রাভিনেতা আহম্মেদ শরীফ
  • কন্ঠশিল্পী নর্গিস পারভীন
  • সাহিত্যিক ও গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী
  • চলচিত্র অভিনেতা মিজু আহম্মেদ
  • নাট্যকর সালাউদ্দিন লাভলু
  • বাউল মামুন নদীয়া
  • মিষ্টার বাংলাদেশ কুস্তিগীর ফটিক দত্ত
  • আন্তর্জাতিক পদকপ্রাপ্ত শ্যুটার সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি
  • আন্তর্জাতিক পদকপ্রাপ্ত শ্যুটার সাবরিনা সুলতানা
  • সংগীত শিল্পী এস আই টুটুল
  • জাতীয় ক্রিকেটার ও নির্বাচক হাবিবুল বাসার সুমন
  • জাতীয় ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়
  • জাতীয় ক্রিকেটার মোহাম্মদ মিথুন

কুষ্টিয়া জেলার দর্শনীয় স্থান

কুষ্টিয়া জেলায় অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। পার্ক, মিউজিয়াম, পুরাকৃত্তি, বিখ্যাত ব্যক্তির আবাসস্থল ছাড়াও অসংখ্য প্রাকৃতিক স্থান ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য বেশ আকর্শণীয়।

কুষ্টিয়ার হাট বাজার

কুষ্টিয়া জেলার প্রধান প্রধান হাট বাজার

  • বালিয়াপাড়া পশু হাট
  • আইলচারা পশু হাট
  • কমলাপুর পশু হাট
  • ঝাউদিয়া বাজার
  • উজানগ্রাম পশু হাট
  • পান্টি বাজার
  • বাঁশগ্রাম বাজার
  • লক্ষিপুর বাজার
  • বিত্তিপাড়া বাজার
  • মধুপুর কলার হাট
  • হরিনারায়নপুর পশু হাট
  • চৌরঙ্গী হাট
  • যদুবয়রা বাজার
  • আলাউদ্দিননগর পশু হাট
  • আটিগ্রাম হাট
  • পোড়াদহ কাপুড়ের হাট
  • মশান বাজার
  • মিতলা বাজার
  • সাতবাড়িয়া পশু হাট
  • জুনিয়াদহ পান হাট

কুষ্টিয়া হতে প্রকাশিত প্রধান প্রধান পত্রিকা

কুষ্টিয়া হতে প্র্রকাশিত পত্রিকা

  • দৈনিক আন্দোলনের বাজার
  • দৈনিক কুষ্টিয়া
  • দৈনিক আজকের আলো
  • দৈনিক আরশীনগর
  • দৈনিক হাওয়া
  • দৈনিক দেশ তথ্য
  • দৈনিক সময়ের দিগন্ত
  • দৈনিক বজ্রপাত
  • দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা
  • দি কুষ্টিয়া টাইমস

কুষ্টিয়া জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়া জেলা শিল্প ও সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। কুষ্টিয়া জেলাকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। কুষ্টিয়া জেলার মানুষের কথ্য ভাষাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে শুদ্ধ ভাষা  অর্থাৎ বাংলাদেশে বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রমিত রূপ বলা হয়ে থাকে।

কুষ্টিয়া জেলার তিলের খাজা ও কুলফি মালাই সারাদেশে বিখ্যাত দুটি খাবার।

1 thought on “কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস”

  1. Pingback: বিপ্লবী বাঘা যতীন | Kushtiainfo

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top