ফকির লালন শাহ

আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন শাহ


ফকির লালন শাহ
, লালন সাঁই, লালন শাহ বা মহাত্মা লালন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, মানবতাবাদী, গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী।

১৯৭৪ সালে নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার ভাড়রা গ্রামে (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়রা গ্রামে) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল শ্রী মাধব কর মায়ের নাম ছিল শ্রীমতি পদ্মাবতী।

অন্য একটি মতে ফকির লান শাহ ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে (পহেলা কার্তিক, ১১৭৯ বঙ্গাব্দ) ঝিনাইদহ জেলা হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কুলবেড়ে হরিষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবার ১৩৪৮ সালে মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে বলে উল্লেখ করা হয়। এখানে তার পিতার নাম কাজী দরীবুল্লাহ দেওয়ান, মাতার নাম আমিনা খাতুন, দাদার নাম কাজী গোলাম কাদির বলে উল্লেখ করা হয়।

স্থানীয় জারিগান, কবিগান, বিভিন্ন বয়াতির গান শুনে অল্প বয়সে লালনের গানের প্রতি আসক্তি জন্মে। গানের দলে যোগ দিয়ে ছন্নছাড়া জীবন শুরু করেন। ভবঘুরে লালকে ঘরমুখী করতে পরিবার তাকে হরিষপুর নিবাসী গোলাব শাহের কন্যা বিসখা বেগমের সাথে বিবাহ দেন। কিছুদিন পর বিসখা বেগমের মৃত্যু হয়। পরে কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের মতিজান বিবিকে বিবাহ করে সেখানে থেকে যান।

তবে অধিকাংশ গবেষকদের মতে যুবক লালন তীর্থ ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। অবচেতন অবস্থায় সঙ্গীরা তাকে একটি ভেলায় কালি নদীতে ভাসিয়ে দেন। নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে মলম শাহের স্ত্রী মতিজান নেছা বাড়ীতে নিয়ে আসেন। মলম শাহ ও মতিজান নেছার সেবা-শুশ্রষায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুস্থ হয়ে লালন নিজ গ্রামে গেলে মুসলমানের ঘরে থাকা-খাওয়ার কারণে তার হিন্দু সমাজ তাকে জাতিচ্যুত করে। ফলে তিনি পুররায় ছেঁউড়িয়া গ্রামে ফিরে আসেন।

ছেঁউড়িয়া ফিরে লালন বাউল সাধক ও গায়ক সিরাজ সাঁয়ের সান্যিধ্যে আসেন এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সিরাজ সাহের সানিধ্যে এসে তার আধ্যাতিক সত্ত্বার বিকাশ ঘটে।

লালনের ধর্মবিশ্বাস

লালনের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মাঝে মতভেদ রয়েছে যা তার জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল। তার জীবদ্দশায় তাকে কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করতে দেখা যায়নি। তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দুধর্ম ও ইসলামধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়। বৌদ্ধ, সুফিবাদ, বৈষ্ণব সহজিয়া ইত্যাদি মতাদর্শের সম্যক জ্ঞান তিনি অর্জন করেছিলেন যদিও সেগুলোও তিনি পালন করেনি।

কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে লোকালয় ছেড়ে বনের মধ্যে তিনি সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তার সাধনার কথা ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোক তার সান্যিধ্যে আসে এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তার অনুমতিতে শিষ্যরা ছেঁউড়িয়া গ্রামে তার একটি আখড়া তৈরী করেন। আখড়াতে লালন তার নিজের দর্শন অনুসারে শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন।

তিনি প্রথমদিকে আখড়ায় কমই থাকতেন। শিষ্যদের নিয়ে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, যশোর, রাজবাড়ী সহ বিভিন্ন স্থানে তার মতবাদ গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। সাধারণ মানুষ সে হউক হিন্দু কি মুসলমান দলে দলে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। তার গানের মধ্যে তারা মানবমুক্তির ঠিকানা খুজে পায়।

প্রতি শীতকালে আখড়ায় ভান্ডারা নামে একটি মহৎসব আয়োজন করতেন। উৎসবে আধ্যাত্বিক আলোচনার পাশাপাশি লালনের লেখা গান পরিবেশিত হত।

লালনের সাথে একই মধ্যযুগের অন্যতম মুসলিম সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন ও গ্রামিন সাংবাদিকতার প্রতিকৃত কাঙ্গাল হরিনাথের বিশেষ সখ্যতা ছিল। শিলাইদহ কুঠিবাড়ীতে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গান সংগ্রহ করেন। যার ২০ টি গান তিনি প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন।

লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরী করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতা জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

লালন শাহের মৃত্যুঃ

১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর ফকির লালন শাহ মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গান-বাজনা করেন। একসময় তার শিষ্যদের বলেন, “আমি চলিলাম” এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়। তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় মৃত্যুর পর হিন্দু বা মসলমান কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি পালন করা হয়নি। তার উপদেশ অনুসারে আখড়ার মধ্যে ঘরের ভিতর তাকে সমাহিত করা হয়।

১৯৬৩ সালে ছেঁউড়িয়ায় আখড়া বাড়ি ঘিরে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ সালে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে শিল্পকলা একাডেমীর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় লালন একাডেমী।

2 thoughts on “ফকির লালন শাহ”

  1. Pingback: টেগর লজ, কুষ্টিয়া | Kushtiainfo

  2. Pingback: কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস | Kushtiainfo

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top