শ্রী শ্রী গোপীনাথ মন্দির

কুষ্টিয়ার প্রাচীন হিন্দু মন্দিরসমূহ

হিন্দু মন্দির:

কুষ্টিয়া বেশ প্রাচীন জনপদ। অতি প্রাচীনকাল থেকে কুষ্টিয়া জেলার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি একটি মানচিত্র তৈরি করেন যাতে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় বেশ কয়েকটি দ্বীপ দেখা যায়। ধারণা করা হয়, এই ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চলই কুষ্টিয়া। কুষ্টিয়া জেলার কিছু প্রাচীন হিন্দু প্রার্থনালায় বা হিন্দু মন্দিরসমূহ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল।

Table of Contents

শ্রী শ্রী কালী পূজা মন্দির, খোকশা

কুষ্টিয়া জেলার প্রাচীন হিন্দু মন্দির সমূহের মেধ্য খোকশা উপজেলার জানিপুরে গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কালী মন্দিরটি অতি প্রাচীন। তবে ঐতিহ্যবাহী এই কালীপূজার প্রচলন কোন সুদূর অতীতে কবে কখন কোথা থেকে শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস খাঁজে পাওয়া যায় না।

তবে বর্তমান পূজারী শ্রী প্রবোধ কুমার ভট্রাচার্যের সপ্তদশ উর্ধ্বতন পুরুষ রামাদেব তর্কলংকার এ পূজার প্রথম পূজারী ছিলেন বলে তিনি দাবি করেন। এই থেকে অনুমান করা হয় খোকশার কালীপূজার বয়স প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর।

প্রচলিত আছে যে, জনৈক জমিদার পুত্রকে সর্প দংশন করলে চিকিৎসার জন্য খোকসা নামক এক জাতীয় গাছে বেষ্টিত জন মনুষ্যহীন জঙ্গলে ধ্যানরত কালীভক্ত এক তান্ত্রিক সাধুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কালীর পদতলে শুইয়ে দিয়ে সাধনার মাধ্যমে সাধু জমিদার পুত্রকে সুস্থ্য করে তোলেন।

সেই জমিদার কালীর প্রতি ভক্তি আপ্লুত হয়ে ও তান্ত্রিক সাধুর নির্দেশে সাড়ে সাত হাত দীর্ঘ কালীমূর্তি নির্মাণ করে মাঘী অমবশ্যার তিথিতে প্রথম কালীপূজা আরম্ভ করেন। কালীপূজা শুরু থেকেই ক্রোধের প্রতীক হিসেবে মহিষ ও পাঁঠা বলির প্রথা চালু হয়।

মধ্যবয়সী এক জোড়া বট পাকুর গাছ বেষ্টিত প্রাত্যাহিক পূজা মন্দির। এখানে রাখা আছে নলডাঙ্গা রাজা ইন্দু ভুষণ দেব রায় কর্তৃক গড়াই নদী থেকে প্রাপ্ত কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তর খন্ড যা বৌদ্ধ আমলের নিদর্শন। পুরাতন পূজা মন্দির বার কয়েক প্রমত্তা গড়াই নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে পূজা মন্দিরটি বর্তমান স্থানে সরিয়ে আনা হয়।

প্রতি বছর একই তিথিতে প্রচলিত নিয়মে ঐতিহ্যবাহী কালীপূজা হয়ে আসছে। কালীপূজা ও বলি উপলক্ষে পূর্বে মাসব্যাপী মেলা বসতো। বর্তমানে এক সপ্তাহ ব্যাপী হওয়া এই মেলায় দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্তের পদচারণ ঘটে।

কালী মন্দিরের পশ্চিমে গড়াই নদীর তীরে নির্মিত হয়েছে ‘খোকসা কেন্দ্রেীয় মহাশ্মশান’।

কুষ্টিয়ার প্রাচীন হিন্দু মন্দির

শ্রী শ্রী গোপীনাথ দেব বিগ্রহ মন্দির ও প্রাচীন সীতারামের মঠ

কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মতি বিজড়িত শিলাইদহ কাচারি বাড়ী হতে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে শিলাইদহ বাজার সংলগ্ন প্রাচীরবেষ্টিত অঙ্গনে অবস্থিত শ্রী শ্রী গোপীনাথ দেব বিগ্রহ মন্দির ও প্রাচীন সীতারামের মঠ।

নির্মাণ আর স্থাপত্য নিদর্শনর এক অপূর্ব সৃষ্টি গোপীনাথ দেব মন্দির। পোড়ামাটির ভাস্কর্য মন্ডিত বাংলা চালারীতির রাধারমণ মন্দির পরিত্যাক্ত হওয়ায় ভেঙ্গে নতুন করে দূর্গামন্দির স্থাপিত হয়েছে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে বাঁকানো কার্ণিশের নিচে পোড়ামাটির ভাস্কর্য ছিল যার অধিকাংশিই বিনষ্ট হয়ে গেছে। চারিদিকে টেরাকোটা ইটে সনাল পদ্ম, চক্র, লতা, পশু-পাখি, ফুল, পাতা ও দেবদেবির মূর্তি শোভিত বিভিন্ন নকশার কারুকার্য।

মূল মন্দিরটি কালের বিবর্তনে ধ্বংশ হলে নাটোরের রাণী ভবানী কর্তৃক নতুন মন্দির স্থাপিত হয়। মূল মন্দিরে চারশত বছরের পুরাতন শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি ছিল যা ভগ্ন হওয়ায় পূজা করা হয়না। নতুন স্থাপিত মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি আছে যার নিত্যপূজা হয়।

২০০৪ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এখানে শ্রী শ্রী দূর্গা মাতার মন্দির স্থাপিত হয়। এখানে গূর্গা মন্দিরের পাশাপাশি কালী মন্দির ও শীব লিঙ্গও রয়েছে।

মূল ভবনের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে একটি বিশাল সীতারামের মঠ। ভূষাণার রাজা সীতারাম রায় প্রায় তিনশত পঁঞ্চাশ বছর পূর্বে মঠটি নির্মান করেন। মঠটি বর্তমানে গাছ, লতাপাতায় আচ্ছাদিত হয়ে পরিত্যাক্ত অবস্থায় কালের স্বাক্ষি হয়ে দাড়িয়ে আছে।

পশ্চিমপাশ্বে দালানমন্দিরে গোপীনাথের স্নানযাত্রা ও দোলের অষ্টকোণাকৃতি কারুকার্যমন্ডিত একটি মঞ্চ আছে। মঞ্চের বেদীতে হাতির শুঁড়ের আদলে তৈরী সাতধাপের সিঁড়িঁসহ রেলিং আছে। দালানমন্দিরে এখনও শালগ্রাম শিলা নিত্যপূজিত। এই পূজাকে কেন্দ্র করে প্রতি আষাঢ় মাসে এখানে মেলা বসে।

ফুলবাড়ি প্রাচীন মঠ ও মন্দির

কুষ্টিয়া জেলার খোকশা উপজেলা শহর হতে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে জয়ন্তীহাজরা ইউনিয়নের মামুদানীপুর গ্রামে ফুলবাড়ি মঠ ও মন্দির অবস্থিত। মামুদানীপুর গ্রামে অবস্থিত হলেও প্রাচীন মঠ ও মন্দিরটি ফুলবাড়ি মঠ নামেই পরিচিত। পরিচিত বললে অবশ্য ভূল হবে। দীর্ঘদিন অবহেলায় লোক চক্ষুর অগোচরে পড়ে থাকায় আশে পাশের অনেকেও মন্দিরটি চেনেন না।

পাঠান রাজত্বের শেষদিকে অথবা মোঘল রাজত্বের প্রথমদিকে ব্রজবল্লভ ক্রেড়ী নামক একজন ধনী বৈষ্ণব মঠ ও মন্দিরটি নির্মাণ করেন এবং রাধারমণ বিগ্রহ স্থাপন করেন।

একটি ত্রিভূজাকৃতি জমিতে মঠ ও মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। ত্রিভূজাকৃতির ভূমির এক কোণে দেতলা মঠটি বটগাছে ছেয়ে ফেলেছে। ভিতরের দেওয়ালের গায়ে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি রাখার কোটর আছে।

ত্রিভূজাকৃতির আরেক কোণে আছে একতলা মন্দির যা তলাপাতা ও ঝোপ-ঝাড়ে ঢেঁকে আছে। তৃতীয় কোণে আছে একটি ভবন। এটি বৃজবল্লভ ক্রোড়ীর বাড়ি ছিল। পরে তিনি ফরিদপুর জেলার মেঘনা গ্রামে স্থান্তরিত হন।

মন্দিরের জায়গা অনেক হাত বদলে বর্তমানে মুন্সী আব্দুল গফুরের মালিকানায় রয়েছে।

কুষ্টিয়ার প্রাচীন হিন্দু মন্দির

বাড়াদী প্রাচীন টেরাকাটা মঠ

কুষ্টিয়া শহরের বাড়াদী গ্রামে জঙ্গল ঘেরা প্রাচীন একটি মঠ আছে। কোন প্রতিষ্ঠালিপি না থাকায় স্থাপনের সময় সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। গ্রামের নাম অনুসারে মঠটি বাড়াদী মঠ নামে পরিচিত।

মঠ মন্দিরটিতে পৌরাণিক, রামায়ণীক, দশাবতার সহ বিভিন্ন ধর্মীয় দৃশ্য, পশুপাখি সহ শিকারের বিভিন্ন দৃশ্য সম্বলিত পোড়ামাটির ভাস্কর্য আছে। প্রবেশদারের উপরে এক জোড়া বিশাল নরসিংহ পরস্পর মুখোমুখি উৎকীর্ণ। এসব কিছু দেখে মঠটি নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে অষ্টদশ শতকের শেষে বা উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে নির্মিত বলে মনে হয়।

চারচলা মঠটি র্জীর্ণ অবস্থায় পরিত্যাক্ত অবস্থায় আছে। মন্দিরের বিগ্রহ শিবলিঙ্গ বর্তমানে নেই। ১৯৪১ সালে বাড়াদির বাবুপাড়ায় শ্রী শ্রী জগমোহন রায় জিউর মন্দির নামে একটি মন্দির স্থাপিত হয়। প্রাচীন মন্দিরের বিগ্রহটি এখানে স্থাপন করে নিত্যপূজা হয়।

ঝোড় জঙ্গলে ঢাকা পরিত্যাক্ত মঠটির জমির বর্তমান মালিক আজিজল হক। অবিলম্বে মঠটি সংস্কার করা না হলে অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হবে।

প্রাচীন মদন মোহন বিগ্রহ মন্দির, কুন্ডুপাড়া

কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলা শহরের কুন্ডুপাড়ায় প্রায় দেড়শত বছরের পুরাতন মদন মোহন বিগ্রহ মন্দিরটি অবস্থিত। রণময়ী দাসী নামক জনৈক নারী ১৮৭৫ সালে মন্দিরটি স্থাপন করেন।

মন্দিরের ভিতরে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও মদন মোহন বিগ্রহ আছে। মন্দির সংলগ্ন পুরাতন ইন্দারা আছে, যা এখন পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। কয়েক দশক আগে এই মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বছর রামলিলা, রাসমেলা, দোলপূর্ণিমাসহ অন্যান্য পূজা পার্বন হতো এবং মেলা বসতো।

বর্তমানে এই মন্দির হতে কুমারখালী শহরে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। দূর্গা পূজা সহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।

কুষ্টিয়ার প্রাচীন হিন্দু মন্দির

শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউর মন্দির

১৯০০ সালে যশোর জেলার নলডাঙ্গার মহারাজা প্রমথভূষণ দেব রায় কর্তৃক দানকৃত জমিতে স্থানীয় হিন্দু ব্যবসায়ীদের সংগ্রহীত চাঁদার টাকায় কুষ্টিয়া আমলাপাড়ায় নবাব সিরাজুদ্দৌলা সড়কে শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

১০০৫ সালে মহারাজা প্রমথ ভূষণ দেব রায় তার স্ত্রীর স্মৃতি রক্ষার্থে শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউর মন্দিরটি পূণনির্মাণ করেন এবং রথের প্রচলন করেন। ১৯১৩ সালে মাখন লাল চৌধুরী নামক একজন হিন্দু ব্যবসায়ী অপূর্ব কারুকার্য খচিত বিরাট পিতলের রথ নির্মাণ করেন। অসামান্য কারুকার্য মন্ডিত দেবদেবীর মূর্তি শোভিত বিশাল আকারে রথটি সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য রথ ছিল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা রথটির পিতল খুলে নিয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে সরকারি অর্থে বর্তমান রথটি নির্মাণ করা হয়। প্রতি বছর রথযাত্রা উপলক্ষে এন.এস.রোড জুড়ে বিশাল রথের মেলা বসে।

রথের কারণে মন্দিরটি রথখোলা মন্দির নামে সাধারণের কাছে পরিচিত।

শ্রী শ্রী জগমোহন রায় জিউর মন্দির

কুষ্টিয়া শহরের বাড়াদী বাবুপাড়ায় ১৯৪১ সালে হিতসাধন সমিতির পরিচালনায় এবং সর্বসাধারণের সাহায্যে শ্রী শ্রী জগমোহন রায় জিউর মন্দিরটি স্থাপিত হয়।

১৯৪৮ সালে শ্রী শ্রী জগমোহন রায় জয়তি স্বর্গীয় রামচন্দ্র সাহা মহাশয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে মন্দির জমি ও নগদ ৩২৫ টাকা উৎসর্গ করেন। এখানে শ্রী শ্রী জগমোহন রায় জয়তি দোলমঞ্চ আছে।

মন্দির আঙ্গিনায় সকল প্রকার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও হিতসাধন সমিতির আয়োজনে প্রতিবছর শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বস্ত্রদান ও গুণী মানুষকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।

বড়বাজার বারোয়ারি মন্দির

কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্র বড়বাজার রেলগেট সংলগ্ন স্থানে বড়বাজার বারোয়ারি মন্দির অবস্থিত। যশোরের মহারাজা প্রমথভূষণ দেবরায় এই মন্দির নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। ১৮৮৬ সালের দিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীগণ চাঁদা তুলে সার্বজনীন পূজা মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

Scroll to Top